সোমবার, ৫ই মে, ২০২৪ ইং, রাত ১২:৩৫
শিরোনাম :

মন্ত্রিসভায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন

ডেক্সরিপোর্ট  ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ বাজেট অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবার (১১ জুন) দুপুরে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আগামী বাজেটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে।

করোনার নাজুক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশায় আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি হবে দেশের ৪৯তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের দ্বিতীয় বাজেট উপস্থাপন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ বাজেট উপস্থাপন করা হবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ‘সমৃদ্ধ আগামীতে’ পৌঁছানের লক্ষ্য স্থির করে যে পথযাত্রা বাংলাদেশ শুরু করেছিল এক ভাইরাসের প্রবল গ্রাসে তা থমকে গেছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ভাবতে হয়েছে আগের উন্নয়ন দর্শনের বাজেটের চেয়ে ভিন্নভাবে। এখন তার প্রধান লক্ষ্য অর্থনীতির ক্ষত সারিয়ে তোলা। বছরের ব্যয়ের খরচ ও জমার ফর্দ সাজাতে গিয়ে তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাত যেন মহামারি সামাল দেয়ার সক্ষমতা পায়, উৎপাদন যেখানে বড় ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে কৃষক যেন অন্তত ফসল ফলাতে পারেন, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে খাদ্য সংকট যেন না হয়; হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষকে যেন সামাজিক নিরাপত্তা দেয়া যায়, বেকারত্ব যেন সমাজকে নতুন সংকটের পথে নিয়ে না যেতে পারে।

এসব দিক সামাল দিয়ে আগামী একবছরে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল মোটামুটি ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা খরচের একটি পরিকল্পনা বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। যা আকারে গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।

প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট গতানুগতিক হচ্ছে না বরং সরকারের অতীতের অর্জন ও উদ্ভূত পরিস্থিতির সমন্বয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে।

করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে চাঙা করতে জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য এ বাজেট পেশ হচ্ছে।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

এ বছর মানুষের জীবন রক্ষা আর জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’।

সঙ্গত কারণেই এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। পাশাপাশি কৃষিখাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরে নানা ধরনের কৃষি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন প্রস্তাবনা থাকছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসছে বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়বাবদ খরচ ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতাবাবদ ব্যয় রাখা হচ্ছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সরবরাহ ও সেবা বাবদ ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদ পরিশোধবাবদ রাখা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। সরকারি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও অনুদানবাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ থাকছে ২ লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

আসছে বাজেটে সরকারের আয়ের মূল উৎস্য রাজস্ব আহরণ। বাজেটে সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আসবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২০ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা কাটছাঁট করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে সংশোধিত আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর আহরণ করবে তিন লাখ ১৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত উৎস থেকে আসবে ৪৪ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।

এদিকে করোনাকালীন এ দুঃসময়ে আয়ের মূল উৎস রাজস্ব আদায় তলানিতে ঠেকলেও বেড়েছে ব্যয়ের খাত। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও এবার বাজেটের যে আকার ধরা হচ্ছে তা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মত বাজেটের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য রেকর্ড জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাজেটে মোট ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দও বাড়াচ্ছে সরকার। এ খাতে এবারই প্রথমবার ৫২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের থেকে পাঁচ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা বেশি।

একইসঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ছয় অর্থবছর ধরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এবার পরিমাণ অন্যবারের তুলনা অনেক বেশি বাড়ছে।

বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আয় ও ব্যয়ের এ বিশাল ফারাকে এবারই প্রথম দেশের ইতিহাসে মোট বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর আগের বছরগুলোতে সাধারণত জিডিপির ৫ শতাংশ হারে ঘাটতি ধরে বাজেট প্রণয়ন করা হতো।

এছাড়া আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ। এডিপির জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা এবং বহিঃসম্পদ থেকে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকার জোগান দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রতিরক্ষাসহ ৯টি খাতে। আসছে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে নতুন বাজেটে এ খাতে ব্যয় করা হবে ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অবশ্য চলতি বছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৩১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এরপরে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়বে ৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এ খাতে মোট বরাদ্দ থাকছে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। আসছে বাজেটে এ খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, এটি মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা। অন্যান্য বছরের মতো এবারও বরাদ্দ বাড়ছে প্রতিরক্ষা খাতে। নতুন বাজেটে এ খাতে ব্যয় করা হবে ৩৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা, চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হবে ৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে থাকছে জরিমানা ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। আগামীতে উৎপাদনশীল শিল্প ও আবাসন খাতে কোনো ধরনের জরিমানা ছাড়াই কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) বিনিয়োগের সুযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার। ফলে যে কেউ অপ্রদর্শিত আয়ের ঘোষণা দিয়ে যেকোনো অঙ্কের অর্থ বৈধ করতে পারবেন। ‘ভলান্টারি ডিসক্লোর অব ইনকাম’ নামে পরিচিত এই নিয়মটি ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবর্তন করা হয়। এ সুযোগ নিতে হলে প্রযোজ্য করহার ও তার সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। আসছে বাজেটে এ জরিমানা তুলে দেয়ার প্রস্তাব আসতে পারে। ফলে জরিমানা ছাড়াই শুধু ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব থাকতে পারে আসছে বাজেটে।

বাড়ছে করমুক্ত আয়ের সীমা: টানা ৫ বছর পর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হবে। করোনাকালীন সময়ে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কষ্ট লাঘবে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

গত আট অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। এটিকে বাড়িয়ে তখন আড়াই লাখ টাকা করা হয়। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ লাখ টাকা ও ২০১৩-১৪ তে ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা।